সুশান্ত সিং রাজপুতঃ পর্দার এম এস ধোনির আনটোল্ড স্টোরি
![]() |
সুশান্ত সিং রাজপুত |
![]() |
এম এস ধোনিঃদ্য আনটোল্ড স্টোরি সিনেমার দৃশ্যে সুশান্ত |
.
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৬ সালে পাটনায় পরিবারের ছোট সন্তান হিসেবে।তার বড় চারজনই বোন। বাবার চেয়ে মায়ের সাথেই বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করতেন।কিন্তু মাকে বেশিদিন পাননি।উচ্চমাধ্যমিক পড়তে থাকা অবস্থায় মাকে হারান।কিন্তু তাতে পড়লেখা থেমে থাকেনি।বাবা চাইতেন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক।সেটা পূরণ করার পথেও গিয়েছিলেন।এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সপ্তম স্থান অধিকার করে দিল্লি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এ মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেন।জাতীয় অলিম্পিয়াডও জেতেন ফিজিক্সে।সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাকভাবে।কিন্তু দেখেন তার ক্যাম্পাসে কোন মেয়ে নেই।এজন্য তিনি ডান্স শিখা শুরু করেন কারণ ডান্স ক্লাসে সুন্দর সুন্দর মেয়ে আসতো

'ফার্স্ট ইয়ারে যখন দেখলাম ক্যাম্পাসে কোন মেয়ে নেই তখন আমি নিজেকে বলতাম যখন পাস করবো ভালো জায়গায় চাকরি করবো তখন মেয়েরা এসে এমনিতেই আমাকে ভালো বলবে।কিন্তু সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ও যখন দেখলাম কোন মেয়ে নেই তখন চিন্তা করতাম তারা কেউ এসে আমাকে বলুক আমি অনেক ভালো পারি।' নিজের শুরুর দিনগুলোর কথা এভাবেই বলেন সুশান্ত।
এরকম ডান্স করতে করতেই একসময় শুরু করেন থিয়েটার করা।থিয়েটারে এমন মজাই পেলেন যে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়ে ফেলবেন।
'আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম অনেক ইন্ট্রোভার্ট।মানুষের সাথে কথা বলতে পারতাম না।থিয়েটার করার সময় দেখলাম আমি হলভর্তি দর্শকের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি।আমি যেহেতু এখানে নিজেকে দেখাচ্ছিনা অন্য আরেকজনের ব্যাক্তিত্ব তুলে ধরছি তাদের সামনে তাই আমার জন্য এটা সহজ মনে হচ্ছিল।এটাতেই আমি উত্তেজনা খুজে পেয়েছিলাম।কিন্তু এটা করতে গিয়ে আমি পরীক্ষায় খারাপ করছিলাম।দেখলাম আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে আরো একটা বছর শুধু শুধু নষ্ট করবো।তাই ছেড়ে দিলাম আর অভিনয় নাচে শতভাগ মনোযোগ দিলাম'।
এতদিন হোস্টেলে থাকায় বাসার কেউ এসব জানত না।কিন্তু এখন তো জানাতেই হয়।তার বাবা স্বাভাবিকভাবেই আপত্তি করলেন। বুয়েটে পড়া কেউ যদি তার বাপকে গিয়ে পাস করার এক বছর আগে বলে সে আর পড়বে না শাকিব খান হবে তাহলে যেকোন বাবা রাগ করবে এটাই স্বাভাবিক। 'আমি তখন বাবাকে বলি তুমি তো চাও আমি যাতে ভালো থাকি সেজন্যই পড়ি।কিন্তু আমি যা করতে চাই সেটা করলেই আমি ভালো থাকবো।যদি সেখানে ব্যার্থ হই তাহলে ফিরে আসবো।এভাবেই বাবাকে রাজি করি' ড্রপ আউটের গল্পটা এভাবেই শুনান সুশান্ত।
.
ড্রপ আউট করার পর পুরোদমে থিয়েটার ডান্স চালিয়ে যেতে থাকেন।এসময় এওয়ার্ড শোগুলোতে ব্যাক ডান্সার হিসেবে কাজ করতে থাকেন।আইফা এওয়ার্ডে কিছুদিন আগে হৃত্বিক রোশনের পেছনে নাচার স্মৃতি মনে করেন।এছাড়া রাজ ২ মুভিতে মুহিত শুরির এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন।ততদিনে নিজের অভিনয় প্রতিভা মোটামুটি জানান দিয়েছেন। যে কারণে 'কিস দেশ ম্যায় হ্যায় মেরা দিল' সিরিয়ালে ডাক পান সাপোর্টিং রোলে।কিন্তু পরের বছর 'পবিত্র রিশতা' তে লিড রোল করার সুযোগ পান আর প্রথমবারের মতো সবার নজর কাড়েন।পুরস্কারও পান সিরিয়ালটি করে।আংকিতা লখন্ডার সাথেও রিলেশন শুরু হয় এই সিরিয়ালের সেটে অভিনয় করার সময়।'আমি তখন চাইছিলাম আমার টাকা আর স্বীকৃতি।টিভিতে কাজ করায় আমি তখন মোটা অংকের টাকা আয় করা শুরু করলাম আর মানুষ জনও আমাকে চিনতে শুরু করলো।আমি তখন শপিং মলগুলোতে ঘুরতে যেতাম যাতে আমাকে দেখে সবাই বলে তারা আমাকে চেনে।' টাকা খ্যাতি সব হওয়ার পর এবার বলিউডে আসতে চাইলেন যে কারণে 'পবিত্র রিশতা' ছেড়ে দেন।
![]() |
আইফা এওয়ার্ডে হৃত্বিক রোশনের ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার |
.
বলিউডে আসলেন শুধু অভিনেতা হিসেবে না রীতিমত মেথড অভিনেতা হিসেবে।অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ তার প্রিয় অভিনেতা ডেনিয়েল ডি লুইস যিনি কিনা মেথড এক্টিং এর রীতিমতো গুরু।বলিউড অভিষেক হয় চেতন ভগতের 'থ্রি মিস্টেকস অফ মাই লাইফ' থেকে এডাপ্টেড 'কই পো ছে' দিয়ে।ক্রিটিক্সদের কাছে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি বেস্ট ডেব্যু এক্টর হিসেবেও নমিনেশন পান এওয়ার্ড শোগুলোতে।এরপর 'শুদ্ধ দেশি রোমান্স' করেও অভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হন।পিকে তে ছোট একটি রোল করেন শুধুমাত্র রাজকুমার হিরানী তাকে ডিরেকশন দিবেন এই জন্য।ছোট রোল হওয়ার পরও 'সরফরাজ ধোকা নাহি দেগা' ডায়লগটা জনপ্রিয় হওয়ায় সরফরাজ হিসেবে তিনি ভালোই পরিচিতি পান।এরপর করেন বিখ্যাত ডিটেক্টিভ উপন্যাস চরিত্র ব্যোমকেশ বকশীকে নিয়ে 'ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বকশী'।এর প্লট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর হওয়ায় এক বছর টিভি ফোন ইন্টার্ভিউ থেকে দূরে ছিলেন যাতে তার কাছে মনে হয় তিনি সেই সময়ে বাস করছেন!এক সপ্তাহ শুধু প্র্যাক্টিস করেছেন ধুতী পড়ে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য।উপন্যাসও পড়ে শেষ করেছিলেন ব্যোমকেশ এর সবগুলো।কিন্তু এত ডেডিকেশন থাকার পরও বাংগালী ব্যোমকেশ হিন্দিতে ঠিক না মানানোর কারণে বক্স অফিসে ব্যার্থ হয়।কিন্তু তার পরেই ক্যারিয়ার এ মোড় ঘোরানো মুভিটি করেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির বায়োপিকে।নিরাজ পান্ডের ডিরেকশন আর ধোনির হাটার স্টাইল,ব্যাট ধরা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জিনিস হুবুহু কপি করে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দেখিয়ে সুশান্ত সিং রাজপুত স্টারের তকমা অর্জন করেন।সমসাময়িক অন্যরা যেখানে একের পর এক গতানুগতিক মাসালা মুভি করে যাচ্ছেন তিনি সেখানে এরকম মুভিগুলোতে সর্বোচ্চ ঢেলে দিয়ে কাজ করছেন।টানা ৬ মাস ক্রিকেট প্র্যাক্টিস করেছেন,ধোনির মতো হেলিকপটার শট শিখেছেন।কিন্তু এসবকে তিনি কোন পরিশ্রমই মনে করেন না।
'আমি স্কুলে থাকতে বিকাল ৪টা থেকে ৫টা ৩০ ছিল আমার খেলার সময়।আমি সারাদিন অপেক্ষা করতাম এই দেড় ঘন্টার জন্য।আমার কাছে এই সময়টা মনে হত মাত্র পাঁচ মিনিটের মতো।ধোনির ব্যাটিং প্র্যাক্টিস করার জন্য অনেকে বলেন আমি অনেক শ্রম দিয়েছি।কিন্তু আমার কাছে এটা ওই দেড় ঘন্টার মতোই ছিল।আমি এর প্রতিটা মুহুর্তই উপভোগ করেছি যে কারণে এটাকে আমার কোন কষ্ট মনে হয়নি।আমার ফিল্মের জন্য কাজ করাও ওই দেড় ঘন্টার মতো মনে হয় আমার কাছে।'
এমএস ধোনি বক্স অফিসে সাকসেস হয়।বক্স অফিসে তার মুভি সফল হোক এটা তিনি অবশ্যই চান কারণ এতে শুধু তিনি নিজে না আরো অনেকের জীবিকা নির্ভর করে।তবে ব্যার্থ হলেও তিনি সেটাকে বেশি নিজের উপর চাপিয়ে দেন না।এজন্যই বলেন
'এম এস ধোনি সফল হওয়ায় আমি এতে প্রথম তিন দিন খুবই খুশি আর উত্তেজিত ছিলাম পরে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাই।ব্যোমকেশ যখন ফ্লপ করে তখনও আমি তিন দিন মন খারাপ করে ছিলাম তারপর আবার স্বাভাবিক হই।আমি জানি বক্স অফিসে আমার মুভি ফ্লপ করতে থাকলে আমি যেসব মুভির কাজ করতে চাই তা আর পাবোনা।কিন্তু আমার অভিনয় থেমে থাকবেনা।আমি হয়ত তখন নাটকে কাজ করা শুরু করবো।সেটা না পারলে একটা ক্যামেরা কিনে নিজেই নিজের শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করবো।কারণ আমি অভিনয়টাকে ভালোবাসি।সেটা যেকোন প্লাটফর্মেই হোক'।.
সময় বেশি ভালো গেলে নাকি মানুষ উল্টাপাল্টা কাজ করা শুরু করে।সুশান্তও তার ব্যাতিক্রম হলেন না।এমনিতে তার কিছু বাজে অভ্যাসও আছে যেমন ধুমপান করা,এলকোহল পান করা।এমএস ধোনি করার পর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা আংকিতা লখন্দার সাথে ব্রেকআপ করেন আর কৃতি শ্যাননের সাথে প্রেম করা শুরু করেন।নারীঘটিত আরো কথাবার্তা শুনা যায় তার নামে।প্রেসেও তর্ক করেছেন।এরোগ্যান্সির কথা অনেক ডিরেক্টরও বলেছেন।তার ফলাফলও পেয়েছেন হাতেনাতে।কৃতির সাথে জুটি,দীপিকার আইটেম সং,রাজকুমার রাওর অদ্ভুত লুক,মাগাধীরা আর গান নিয়ে অনেক কন্ট্রোভার্সিতে প্রচারণা পাওয়ার পরেও ৫৫ কোটি বাজেটের 'রাবতা' বক্স অফিসে মুখ ধুবরে পড়ে।তবে সুশান্ত এতদূর যেহেতু আসতে পেরেছেন নিজের যোগ্যতায় আবার ফিরেও আসতে পারেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে।সামনে তার কিছু ভালো মুভি আসার সম্ভাবনা আছে।
সুশান্ত বর্তমানে প্রেম করছেন অভিনেত্রী কৃতি শ্যাননের সাথে |
.
সুশান্ত অভিনেতার পাশাপাশি একজন সাহিত্য অনুরাগী।তার ইন্সটাগ্রামের পোস্টগুলো দেখলেই বুঝা যায় প্রচুর বই পড়েন।লেখালেখিও করেন টুকটাক।২৩টি শর্টফিল্ম লেখেছেন।শুধু লেখেনই না যারা মৌলিক গল্পের তরুণ ভালো লেখক আছেন তাদের জন্যও এগিয়ে এসেছেন তিনি একটা ওয়েবসাইট নিয়ে।মুভিও দেখেন প্রচুর।
.
বর্তমানে বলিউডে যেখানে নেপোটিজমের জন্য বাইরের কেউ আসতে পারছেনা সেখানে সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো ননফিল্ম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসাদের সাকসেস দেখতে ভালোই লাগে।যখন মুম্বাই আসেন তখন স্বপ্ন দেখতেন ইয়াশ রাজ ফিল্মসের সাথে কাজ করবেন,পেপসির বিজ্ঞাপনে কাজ করবেন আর ফিল্মফেয়ারের ম্যাগাজিনে কভার পেজে থাকবেন।তিনটি ইচ্ছাই পূরণ করে ফেলেছেন।ও হ্যা যে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দিছিলেন তার কলেজ তাকে ডিগ্রি দিয়ে দিছে যে কারণে তিনি এখন এক্টর+ইঞ্জিনিয়ার=এক্টনিয়ার


No comments