রহস্যময় ডিবি কুপারঃ এফ বি আই এর দুঃখ
১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর।থ্যাংকস গিভিং এর ঠিক আগের দিন বিকেলে আমেরিকার পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চল্লিশের মাঝামাঝি বয়সী এক লোক আসলেন ওয়াশিংটন এর সিয়াটলে যাত্রার উদ্দেশ্যে।৫ ফুট ১০ ইঞ্চির একটু বেশি উচ্চতার লোকটির পড়নে কালো স্যুট আর রেইনকোট।কালো প্যান্ট এর সাথে বাদামী লোফার জুতা।গলায় কালো টাই বাঁধা।হাতে এটাচি কেস।ঠিক যেন কর্পোরেট জগতের মানুষ।বিমানবন্দরে এসে ২০ ডলার দিয়ে নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্স এর ৩০৫ নম্বর ফ্লাইট এর টিকেট কিনলেন সিয়াটল যাওয়ার উদ্দেশ্যে।টিকেটে নাম লেখালেন ড্যান কুপার।বাকিটা ইতিহাস।তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে গেলেন ডিবি কুপার নামে।কি জন্য বিখ্যাত?ড্যান কুপার না হয়ে ডিবি কুপার নামেই বা কেন পরিচিত?
ডিবি কুপার।তাকে বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলাই ভালো।অন্তত আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর কাছে তাই।কারণ সেদিন তিনি যে বিমানে উঠেছিলেন সেটা তিনি 'ছিন্তাই' করেছিলেন।বিমান ছিন্তাই করার ঘটনা এটিই একমাত্র নয়।বিমান ছিন্তাইয়ের ঘটনা ইতিহাসে আরো অনেক আছে।কিন্তু ডিবি কুপারের বিশেষত্বটা কি?কারণ তিনি বিমান ছিন্তাই করলেও বিমানে থাকা অন্য ৩৬ জন যাত্রীর কোন ক্ষতি করেননি।তার চেয়েও বড় কথা তিনি মাঝ আকাশের মধ্যে বিমান থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যান।তাকে আর কোনদিন পাওয়া যায়নি।এমনকি তার কোন লাশও পাওয়া যায়নি।দীর্ঘ ৪৫ বছর এফবিআই ড্যান কুপারকে হন্যে হয়ে খুঁজেও কোন কূল কিনারা পায়নি।শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে তাকে নিয়ে তদন্ত বন্ধ করে দেয়।তার নাম ড্যান কুপার হলেও পত্রপত্রিকায় ভুলে ডিবি কুপার নামে ছাপা হয়ে যায়।পরে ড্যান কুপার নামটির চেয়ে ডিবি কুপার নামটিই বেশি জনপ্রিয়তা পায়।কে এই ডিবি কুপার?
বোয়িং ৭২৭ বিমানটি সেদিন বিকাল তিনটায় উড্ডয়ন শুরু করে।কুপার বসেছিলেন সবার পেছনের সিটে।একটু পর ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট ফ্লোরেন্স শেফনার এর কাছে দুই গ্লাস ড্রিংকস অর্ডার করেন।শেফনার ড্রিংকস নিয়ে আসলে তাকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেন কুপার।শেফনার মনে করেন কুপার হয়ত তার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছেন।চিরকুটে হয়ত তার ফোন নম্বর দিয়েছেন মনে করে সেটা না পড়েই পার্সে রেখে দেন শেফনার।বিষয়টি লক্ষ করে কুপার নিচু গলায় বললেন----
ম্যাডাম আপনার উচিত চিরকুটটি পড়ে দেখা।আমার সাথে বোমা আছে।
শুনে ভীত সন্ত্রস্ত শেফনার চিরকুটটি খুলে দেখেন আসলেই তা লেখা।
শেফনারকে তখন কুপার তার পাশের সিটে বসতে বলেন।শেফনার তা করতে বাধ্য হলেন।কুপার তখন এটাচি কেস বের করে তার ভিতর রাখা বোমা দেখালেন।৪৭ বছর আগে স্থানীয় বিমান যাতায়াত এর ক্ষেত্রে যাত্রীদের চেকিং করা হতোনা।শুধু টিকেট করেই বিমানে উঠে যাওয়া যেত।তাই কুপার বোমা নিয়ে বিমানে উঠে যেতে পেরেছিলেন।
![]() |
নর্থওয়েষ্ট এয়ারলাইন্স এর বোয়িং ৭২৭ বিমানটি |
শেফনারকে তখন কুপার জানান সিয়াটলে অবতরণ করার পর তাকে যেন ২ লক্ষ ডলার ক্যাশ দেওয়া হয় এবং ২টি ফ্রন্ট প্যারাস্যুট ও ২ টি ব্যাক প্যারাস্যুট দেয়া হয়।আর বিমানবন্দরে যেন ফুয়েল ট্রাক থাকে, সাথে কিছু খাবার।অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কুপার ২ লক্ষ ডলার চাইছিলেন সব যেন ২০ ডলারের নোট হয়।সেসময়ের ২ লক্ষ ডলার বর্তমানের ১.২ মিলিয়ন ডলারের সমান। শেফনার তখন ইন্টারকমের মাধ্যমে খবরটি ককপিটে পৌছে দেন।পাইলটরা তখন নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্সকে জানান।একইসঙ্গে এফবিআইকেও জানানো হয়।কিন্তু বাকি যাত্রীরা এসব কিছুই জানতোনা।
এফবিআই তখন একটি নির্দিষ্ট সিরিয়াল নাম্বারের ২০ ডলারের নোটযুক্ত ২ লক্ষ ডলার প্লেনে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে যেন কুপার পালাতে পারলেও তাকে ধরা যায়।শেফনারকে দিয়ে তার চাহিদামাফিক জিনিস পাওয়ার পর কুপার যাত্রীদের সবাইকে ছেড়ে দেন।শেফনারকেও ছেড়ে দেন।যদিও বোমা দেখানো ছাড়া বিমানে বাকি সময়টা একজন ভদ্র লোকের মতোই ছিলেন ডিবি কুপার।বিমানে থাকেন শুধু তিনজন পাইলট,একজন এটেনডেন্ট আর ডিবি কুপার।
ডলার আর প্যারাস্যুট হাতে পাওয়ার পর কুপার পাইলটকে বলেন মেক্সিকো সিটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।এদিকে কিছুক্ষণ উড়ার পর তখন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আর বাজে আবহাওয়া থাকায় পাইলট মেক্সিকো সিটির চেয়ে নেভাডার রেনোতে অবতরণ করাটা যুক্তিযুক্ত বললেন।কুপার তাতে সায় দেন।বিমান যাত্রার এই অংশটুক তিনি সানগ্লাস পড়ে ছিলেন।
কুপার পাইলটকে ১০০০০ ফুট এর কম উচ্চতায় বিমান রাখতে বলেন।তবে বিমানের রুট নিয়ে কিছু বলেননি।সেটা পাইলট তার ইচ্ছানুযায়ীই চালান।এদিকে এফ বি আই এর দুটি বিমান তখন এই বোয়িং ৭২৭ কে অনুসরণ করতে থাকে।একটি থাকে ৭২৭ এর উপরে অন্যটি থাকে নিচে।রাত ৮ টার দিকে এটেন্ডেন্টকে ককপিটে চলে যেতে বলেন।এটেনডেন্ট তখন দেখতে পান কুপার ডলার এর ব্যাগটি আর প্যারাস্যুট তার শরীরে বাঁধছেন।একটু পর ককপিটে সবাই টের পান বিমানের পেছনের দরজাটি খুলে যাচ্ছে।কিন্তু সবাই তখন আংকে আছেন।কেননা কুপার তখন বোমাটি বিমানে বিস্ফোরিত করে প্যারাস্যুট নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেটাই ভাবছিলেন তারা।
কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।রেনোতে বিমান নিয়ে নামার পর পুলিশ এফবিআই বিমানটিকে ঘিরে ফেলার পর দেখা যায় পেছনের দরজাটি খোলাই আছে।৪ টি প্যারাস্যুট এর মধ্যে দুটি নেই আর দুটি রয়ে গেছে আর কুপারের সিটে তার টাইটি পড়ে আছে।আর কিছু নেই।
![]() |
ডিবি কুপারের সেই টাই |
![]() |
বিমানে রয়ে যাওয়া প্যারাস্যুট |
অনুমান করা হয় রাত ৮টা থেকে ৮ টা ১০ মিনিটের দিকে বিমান যখন লুইস নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন ঝাপ দেন ডিবি কুপার।রহস্যজনক ব্যাপার হলো এরপর থেকে তাকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি।তার লাশও পাওয়া যায়নি।বোয়িং ৭২৭ কে অনুসরণ করা বিমান দুটিও তার লাফ দেয়া টের পায়নি। তার প্যারাস্যুটও মাটি বা নদীর পানি কোথাও পাওয়া যায়নি।তার নামটিও ছিল ভুয়া। তার সাথে বিমানে সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো এটেনডেন্ট ফ্লোরেন্স শেফনার ও টিনা মাকলোর কাছ থেকে তার চেহারার বর্ণনা ও উচ্চতা অনুযায়ী স্কেচ আঁকা হয়।কিন্তু কুপার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।
![]() |
ডিবি কুপারের স্কেচ |
সমগ্র এলাকা জুড়ে চিরুণী অভিযান চালাতে থাকে এফবিআই।তার স্কেচ জনগণের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।স্থলপথ বন জংগলে তো খোঁজা হয়ই সাথে সাবমেরিন দিয়ে নদীর পানির নিচেও খুঁজা হয়।কিন্তু কুপারকে পাওয়া যায়নি।নর্থওয়েষ্ট এয়ারলাইন্স আর হাইজ্যাক একসাথে করে এই কেস এর নাম দেয়া হয় 'নরজ্যাক'।কিন্তু এফবিআই এর জন্য নরজ্যাক একেবারে নরকে পরিণত হয়।৫ বছরে প্রায় ৮০০ সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়।কিন্তু কারো সাথেই ডিবি কুপারের কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়না।তবে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা হয় যাকে এবং এফবিআই এর কাছে সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য সন্দেহভাজন ব্যাক্তি যিনি তিনি হচ্ছেন রিচার্ড ফ্লয়েড ম্যাককয় জুনিয়র।
![]() |
রিচার্ড ফ্লয়েড ম্যাককয় জুনিয়র |
কুপার এর ঘটনার পর তাকে নকল করে আরো বেশ কিছু বিমান ছিন্তাই এর ঘটনা ঘটে।সেই ঘটনার ৫ মাস পর ম্যাককয় একই কায়দায় কুপারের মতো বিমান ছিন্তাই করেন।তিনি ২ লক্ষ ডলারের জায়গায় ৫ লক্ষ ডলার দাবি করেন।তবে তিনি পরের দিনই ধরা পড়েন এফবিআই এর কাছে।তিনি ছিলেন একজন প্যারাট্রুপার।ধারণা করা হয় তিনিই ডিবি কুপার।তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের ডিবি কুপারের বর্ণার সাথে ডিবি কুপারের মিল না থাকায় এফবিআইকে আবারো হতাশ হতে হয়।ম্যাককয়ের ৪৫ বছরের জেল হয়।পরে তিনি জেল থেকে পালাতে গিয়ে এফবিআই সদস্যের গুলিতে মারা যান।
ডিবি কুপার রহস্য হয়েই থেকে যান।এদিকে অনেকে নিজেকে ডিবি কুপার দাবি করা শুরু করেন,কেউবা বলেন তার ভাই ডিবি কুপার।কিন্তু কোনটিই এফবিআইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা।শেষ পর্যন্ত সেই ঘটনার ৯ বছর পর কুপারের কিছুটা হলেও আলামত পাওয়া যায়।
![]() |
টিনা বারে পাওয়া ডিবি কুপারকে দেয়া ডলারগুলো |
কলাম্বিয়া নদীর তীরে টিনা বার নামক একটি জায়গায় ব্রায়ান ইনগ্রাম নামের ৮ বছরের একটি ছেলে আসে বাবা মায়ের সাথে পিকনিক করতে।ক্যাম্প ফায়ার করতে গিয়ে সে ২০ ডলারের কিছু বান্ডিল দেখতে পায়।এফবিআই সেসময় ডিবি কুপারকে দেয়া ডলারগুলোর সিরিয়াল নাম্বারগুলো প্রকাশ করেছিল।ইনগ্রামের বাবা মা সেগুলো দেখে বুঝতে পারে এই ডলারগুলো ৯ বছর আগে ডিবি কুপারকে দেয়া নোটগুলোই।তারা এফবিআই এর কাছে ডলারগুলো দেয়।তখন এফবিআই সে এলাকা খুড়ে চষে বেড়ায়।কিন্তু আর কোন হদিস পায়না।এদিকে তখন শুরু হয় নতুন বিতর্ক।এফবিআই এর অনুমান করা এলাকার প্রায় ২০ মাইল দূরে ডলারের নোটগুলো পাওয়া যায়।নোটগুলো এতদূর কিভাবে আসলো সেটা নিয়ে অনেক তত্ত্ব তৈরি হয়।কুপারকে ২ লাখ ডলার দেয়া হলেও সেখানে মোট ৫৮০০০ ডলার পাওয়া যায়। তবে এত কিছুর পরও এফবিআই তাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।এমনকি বয়স্ক অবস্থায় তাকে কেমন অবস্থায় দেখা যেতে পারে সে স্কেচটাও প্রকাশ করা হয়েছে।
![]() |
বয়স্ক ডিবি কুপারের স্কেচ |
এছাড়া তাকে নিয়ে আরো বহু বিতর্ক আছে।কেউ মনে করেন কুপার এখনো জীবিত আছেন আবার কেউ মনে করেন তিনি বিমান থেকে ঝাপ দিয়েই মারা গেছেন।বিমানের নিচে মাটিতে তার কোন সহযোগী ছিল কিনা সে প্রমাণও পাওয়া যায়নি।কেউ মনে করেন তিনি অভিজ্ঞ প্যারাট্রুপার ছিলেন আবার কেউ তা অস্বীকার করেন।২০০৭ সালে তাকে নিয়ে আবার নতুন করে তদন্ত শুরু হলে বলা হয় ডিবি কুপার সম্ভবত বেলজিয়ান কমিক ড্যান কুপারের ফ্যান ছিলেন।কমিকের নায়ক ড্যান কুপার একজন প্যারাট্রুপার ছিলেন।কিন্তু সেটাও তার খোঁজ পেতে কোন সাহায্য করে না। সব মিলিয়ে আমেরিকার ইতিহাসে ডিবি কুপার একজন রহস্যমানব হয়েই থাকবেন।তিনি কারো কাছে কুখ্যাত লুজার আবার কারো কাছে কিংবদন্তি।শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের ১২ জুলাই এফবিআই ডিবি কুপারের তদন্ত বন্ধ করে দেয়।তবে কেউ তার কোন আলামত বা খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাতে বলা হয়েছে।
No comments